যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়া দেশে যেন আর কোনো সমস্যা নেই। সবার মুখে একই আলোচনা। কারো চেয়ে কেউ কম নয়। মনে হয় সবাই যেন বিশেষজ্ঞ। বলতে গেলে গোটা জাতি একটি উন্মাদনায় মেতেছে। লোকজনের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় যুদ্ধ যেন ছেলের হাতের মোয়া। যুদ্ধ কত ব্যাপক এবং কত ভয়াবহ হতে পারে সে জ্ঞান থাকলে যখন-তখন যাকে খুশি তাকে যুদ্ধাপরাধী বলা সম্ভব হতো না। যুদ্ধ তো শুধু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীতে যুগে যুগে যুদ্ধ হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরো হবে। ৪০ বছর আগে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও জাতি আজো যুদ্ধের চোরাবালি থেকে মুক্ত হতে পারছে না। বারবার জাতিকে অতীতে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে। যেন এখনো যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ কখনো কারো কাম্য হতে পারে না। তার পরও যদি যুদ্ধের কালোছায়া মাথার ওপর উদ্ধত ফণা বিস্তার করে তখন কথা না বলে পারা যায় না। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস ও পাশবিকতা, যুদ্ধ মানেই মানবতার মৃত্যু। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোনো যুদ্ধ হয়নি যেখানে একটিমাত্র পক্ষ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং অন্য পক্ষ কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে যে, যুদ্ধে উভয় পক্ষই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। কিন' মানব জাতির জন্য দুর্ভাগ্য এটাই যে, জেনেভা কনভেনশন এবং হেগ চুক্তিতে বিজয়ীদের ইচ্ছামতো বিচার করার একটি উন্মুক্ত অধিকার দেয়া হয়েছে। এ মৌলিক দুর্বলতাকে বিজয়ী শক্তিগুলো তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করছে।
জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হলেও যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আদালতের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়নি। জেনেভা কনভেনশনে যদি এমন শর্ত থাকত যে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষের নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব কিংবা কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না তাহলে এত বছর পরও নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়ে দেশ ও বিদেশে উদ্বেগ দেখা দিতো না। বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক মান রক্ষার দোহাই দেয়া হলেও এ আদালতে বিচারের রায় কী হবে তা প্রায় একপ্রকার নিশ্চিত। নিজস্ব আইনের আওতায় কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে বলে সবাই উৎসাহের সাথে নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছে। কিন' বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কোনো আদালতে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে চটপট সমর্থন দেয়ার আগে অন্তত ১০ বার ভাবতে হতো। অনেকের মুখ কালো হয়ে যেত। কথায় কথায় যুদ্ধাপরাধী শব্দটি উচ্চারিত হতো কি না সন্দেহ।
অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ একটি ঘৃণ্য অপরাধ। কিন' আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোথাও কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে কি না সন্দেহ। এ কথা শুনে হয়তো অনেকের আক্কেল গুড়-ম হবে। সততার সাথে বলতে গেলে বলা উচিত বিজয়ীদের আদালতে তাদের শর্তে তাদের আইনে তাদের ইচ্ছামতো পরাজিতদের বিচার। আরো সোজা করে বলতে গেলে বলা উচিত রাজনৈতিক প্রতিশোধ গ্রহণের বিচার। তাহলে হবে সঠিক উচ্চারণ। ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো উল্টালে এ সত্য মানতেই হবে।
বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়ার আগে অতীতের কয়েকটি ট্রাইব্যুনাল, বিশেষ করে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। কেননা এ আদালত নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের অনুকরণে গঠন করা হয়েছে। আবার টোকিও ট্রাইব্যুনালের আলোচনা ছাড়া নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আলোচনা করা হবে অসম্পূর্ণ। এ দু’টি ট্রাইব্যুনালে কাদের বিচার করা হয়েছিল, অভিযুক্তরা ন্যায়বিচার পেয়েছিল কি না, কোন আইনের আওতায় বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছিল, কারা বিচারক ছিলেন এবং ইতিহাস এ বিচারকে কিভাবে মূল্যায়ন করছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রথমেই নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আলোচনা করা যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টে জড়িত নাৎসিদের দু’টি পৃথক বিচারের সাধারণ নাম নুরেমবার্গ ট্রায়াল বা নুরেমবার্গ বিচার। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে নুরেমবার্গ প্যালেস অব জাস্টিসে এ বিচার অনুষ্ঠিত হয়। এসব বিচারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিচার ছিল আন্তর্জাতিক সামরিক আদালত বা আইএমটিতে মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এ আদালতে নাৎসি জার্মানির ২৪ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিচার করা হয়। ১৯৪৫ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত এ বিচার চলে। ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট ঘোষিত লন্ডন সনদের ভিত্তিতে এ বিচারের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। লন্ডন সনদে এ বিচার ইউরোপীয় অক্ষ দেশগুলোর মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এ সনদে এটাও উল্লেখ করা হয় যে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে না। জার্মানির আত্মসমর্পণের দলিলে বর্ণিত শর্তাবলি ছিল এ আদালতের এখতিয়ারের আইনগত ভিত্তি। আত্মসমর্পণ করায় জার্মানির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এলায়েড কন্ট্রোল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। ২৪ জন শীর্ষ জার্মান যুদ্ধবন্দীর মধ্যে ২১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তারা হলেন : মার্টিন বোরম্যান (নাৎসি দলের সেক্রেটারি), অ্যাডমিরাল কার্ল ডোয়েনিৎস (জার্মান নৌবাহিনী প্রধান), হ্যান্স ফ্রাঙ্ক (অধিকৃত পোল্যান্ডে জার্মানির গভর্নর জেনারেল), উইলহেম ফ্রিক (নাৎসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), হ্যান্স ফ্রিৎজশি (নাৎসি প্রচার মন্ত্রণালয়ের বার্তা বিভাগের প্রধান), ওয়ালথার ফ্রাঙ্ক (অর্থমন্ত্রী), ফিল্ড মার্শাল গোয়েরিং (জার্মান বিমান বাহিনী প্রধান), রুডলফ হেস (জার্মানির ডেপুটি ফুয়েরার), জেনারেল আলফ্রেড জোডল (জার্মান সেনাবাহিনী প্রধান), জেনারেল আর্নেস্ট কালটেনব্রুনার (এসএস কমান্ডার), ফিল্ড মার্শাল উইলহেম কিটেল (জার্মান সেনাবাহিনীর কমান্ডো প্রধান), গুস্তাভ ভন বোহলেন (শীর্ষ নাৎসি শিল্পপতি), রবার্ট লে (জার্মান শ্রমিক দলের প্রধান), কন্সটান্টাইন ভন নিউরথ (জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী), ফ্রাঞ্জ ভন পাপেন (হিটলারের আমলে জার্মান উপ-চ্যান্সেলর), অ্যাডমিরাল এরিক রিডার (জার্মান নৌবাহিনী প্রধান), ভন রিবেনট্রপ (জার্মান পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী), আলফ্রেড রোজেনবার্গ (জার্মান বর্ণবাদী তাত্ত্বিক ও মন্ত্রী), আর্নেস্ট ফ্রেডারিক সাউকেল (জেনারেল প্লেনিপোটেনশিয়ারি), ড. হাজেলমার সাচেৎ (জার্মান ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ), বালডর ভন শিরাচ (হিটলারের যুব শাখার প্রধান), আর্থার সেচ ইনকুয়ার্ট (অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর), আলবার্ট স্পিয়ার (জার্মান সমরমন্ত্রী), জুলিয়াস স্ট্রেচার (ডার স্টারমারের প্রকাশক ও প্রতিষ্ঠাতা)।
নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের বিচারক জন জে. পার্কার ও ফ্রান্সিস বিডল ছিলেন আমেরিকান, লে. কর্নেল আলেক্সান্ডার ভোলচকোভ ও মেজর জেনারেল আইয়োনা নিকিৎচেনকো ছিলেন সোভিয়েত, কর্নেল স্যার জিওফ্রে লরেন্স ও নরম্যান বিরকেট ছিলেন ব্রিটিশ, অধ্যাপক হেনরি দনিদিউ দ্য ভাবরেজ ও রবার্ট ফলকো ছিলেন ফরাসি। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন রবার্ট এইচ জ্যাকসন (মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি), ব্রিটেনের পক্ষে হার্টলি শক্রুজ, সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে জেনারেল আর এ রোডেনকো এবং ফ্রান্সের পক্ষে ফ্রাঙ্কো দ্য মেন'ন ও অগাস্টি শাম্পি টিয়ার দ্য রিবেস।
বিবাদিদের আপিল করার সুযোগ ছিল না। তা ছাড়া বিচারক নিয়োগে তাদের আপত্তি করাও সম্ভব ছিল না। এসব ত্রুটি ও অসঙ্গতি থাকায় বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তি এ ট্রাইব্যুনাল গঠনে বৈধতার প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ বলছেন, বিজয়ী শক্তি বিচারক নিয়োগ করায় এ ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষ ছিল না এবং প্রকৃত বিবেচনায় তাকে আদালত হিসেবে গণ্য করা যায় না। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছিল তা একেবারে অমূলক ছিল না। ১৯৩৬-৩৮ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে নিয়োজিত প্রধান সোভিয়েত বিচারক নিকিৎচেনকো স্টালিনের শো ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ফলে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। আগে কৃত অপরাধের ভিত্তিতে বিবাদিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। কোনো নির্দিষ্ট দেশের নিজস্ব আইনে এসব অভিযোগ আনা হয়নি। বিবাদি পক্ষের কোনো আইনজীবী ছিল না। আদালতে একচেটিয়া ছিল বিজয়ী মিত্রশক্তির প্রতিনিধিত্ব। আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত সনদের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল যে, এ আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণে টেকনিক্যাল রীতিনীতি মানতে বাধ্য নয়। এতে আরো বলা হয়, এ আদালত রায়দানে যত দূর সম্ভব নিজস্ব বিচারবুুদ্ধি ও নন-টেকনিক্যাল পদ্ধতি অনুসরণ করবে এবং প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করলে যে কারো সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারবে।
একই গ্রনে'র ২২৫ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি আরো লিখেছেন, 'All regime trials occur after a period of war, civil war, revolution or all three, immense collective passions are invariably unleashed by them. Very often the public bays for the defandants blood outside the courtroom (and occassionally inside it too). Accusations itself are very instrumentalized precisely in order to create social cohesion after a period of internal division. The act of accusation becomes more powerful and intoxicating the more public and collective it is. The intensity of the passions generated, combined precisely with the desire to use them to create a new political order on the ruins of the old one, has often meant that the charges brought are exaggarated or wrong. To be sure, many of the men in the dock whose trials are discussed in this book had acted venally, vainly, dishonestly, cruelty, evilly and often illegally. Nonetheless, they were often prosecuted for other things or on the basis of newly invented laws which they had not done.’
অর্থাৎ ‘যুদ্ধ, বিপ্লব অথবা গৃহযুদ্ধ অথবা এ তিনটি শেষ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো বিচারের আয়োজন করে। যুদ্ধোত্তর সরকারগুলো অপ্রতিরোধ্য আবেগ ছড়িয়ে দেয়। জনতা আদালতের বাইরে (কখনো কখনো আদালতের ভেতর) অভিযুক্তদের রক্ত চায়। সামাজিক অসি'রতা সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে অভিযোগ ছড়িয়ে দেয়া হয়। অভিযোগগুলো হয় অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তাতে জনগণের মন বিষিয়ে ওঠে। পুরনো রাজনৈতিক ব্যবস'ার ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন ব্যবস'া গড়ে তোলার লক্ষ্যে তীব্র আবেগ ফেনিয়ে তোলা হয়। তার মানে হলো যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল সেগুলো ছিল হয়তো অতিরঞ্জিত, নয়তো ভুল। নিশ্চিতভাবে এ বইয়ে যেসব অভিযুুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তাদের অনেকেই অসাধু, অবৈধ, নিষ্ঠুর, অশুভ, নিষ্ফল কিংবা লালসাপূর্ণ কাজ করেছেন। কিন' নয়া আইনে তাদের বিচার করা হয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে যা তারা করেননি।’
উইকিপিডিয়া : দ্য ফ্রি এনসাইক্লোপিডিয়ায় বিজয়ীদের চাপিয়ে দেয়া বিচারের একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, 'The `victor’s justice’ (in German Siegerjustiz) is a situation in which an entity partakes in carrying out `justice’ on its own basis of applying different rules to judge what is right or wrong for their own forces and for those of the ( former) enemy. Advocates generally charge that the difference in rules amounts to hypocrisy and leads to injustice. Targets may consider it derogatory.’ অর্থাৎ ‘বিজয়ীদের চাপিয়ে দেয়া বিচার হলো এমন একটি পরিসি'তি যেখানে একটি রাষ্ট্রসত্তা তাদের নিজেদের এবং (সাবেক) শক্র বাহিনীর জন্য ভুল অথবা শুদ্ধ রায়দানে যেকোনো আইন প্রয়োগ করে নিজেদের মতো করে বিচারকার্য পরিচালনা করেন। কৌঁসুলিরা সাধারণত এমন অভিযোগ উত্থাপন করেন যা প্রতারণার শামিল এবং এ প্রতারণা অবিচারের দিকে ধাবিত করে। অভিযুক্তরা এ বিচারকে ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করতে পারেন।’
ওপরে উল্লেখিত বক্তব্যগুলোর মমার্থ হচ্ছে যে, বিজয়ীরা তাদের নির্ধারিত শর্তে পরাজিতদের বিচার করছেন। বিজয়ীদের কোনো বিচার হয়নি। বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালেও বিজয়ীদের ইচ্ছামতো বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ১৯৭৩ সালে সংবিধান সংশোধন করে বিচারের দায় থেকে একটি পক্ষকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালে ঘোষিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল লিবারেশন স্ট্রাগল (ইনডেমনিটি) অর্ডার’-এ বলা হয়, 'No suit, prosecution or other legal proceeding shall be lie in any Court against any person for or on account of or in respect of any act done during the period from the 1st day of March, 1971 to the 16th day of December, 1971, in connection with the struggle for national liberation or for maintenance or restoration of order up to the 28th day of February, 1972. অর্থাৎ ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অথবা ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কৃত যেকোনো কার্যকলাপের জন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো মামলা, অভিযোগ অথবা অন্য কোনো আইনগত শুনানি গ্রহণযোগ্য হবে না।’
গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগী বাহিনীর বিচারে এ সংশোধনী আনা হয়েছিল। কিন' আইনটি কার্যকর হওয়ার আগেই সিমলা চুক্তির আওতায় পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীরা মুক্তি পেয়ে নিজ দেশে ফেরত যায়। এ সম্পর্কে ব্রিটিশ আইনজীবী ব্যারিস্টার জন কমেহ ‘দ্য বাংলাদেশ ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল: রিকনসিলিয়েশন অর রিভেঞ্জ’ শিরোনামে এক ভাষ্যে লিখেছেন, 'In the spirit of peace and reconciliation Sheikh Mujibur swiftly repatriated several hundred Pakistani prisoners of war following the tripartite Simla Agreement with India and Pakistan. Following Mujibur’s Presidential Order No. 16 in 1973, in which a blanket amnesty was granted to all participants ‘in connection’ with the conflict.’ অর্থাৎ ‘ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সিমলা চুক্তির পর শান্তি ও সমঝোতার চেতনায় শেখ মুজিবুর রহমান কয়েক শ’ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে দ্রুত ফেরত পাঠান। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার নম্বর ১৬-তে যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সকল অংশগ্রহণকারীকে সাধারণ ক্ষমা মঞ্জুর করা হয়।’
একই ভাষ্যে তিনি আরো লিখেছেন, 'Deft amendment of the 1973 Act found a way past this problem in 2009, adding the new category of ‘individuals’ to the original ICTA targets of anti-liberation armed forces and auxiliary personnel. By contrast, immunity for pro-liberation freedom fighters remained intact, irrespective of their conduct in the conflict. Now, with this loophole in place, what was originally drafted in 1973 as a vehicle to prosecute military excesses during the conflict had assumed the appearance of a means of pursuing pre-selected civilian targets 40 years later.’ অর্থাৎ ‘১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের এ চাতুর্যপূর্ণ সংশোধনীর সমস্যা উত্তরণে ২০০৯ সালে একটি উপায় খুঁজে বের করা হয়। স্বাধীনতা বিরোধী সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের সহায়ক বাহিনীর বিচারে প্রণীত মূল ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে (আইসিটি) ব্যক্তিবর্গের বিচারে নয়া ক্যাটাগরি যুক্ত করা হয়। পক্ষান্তরে, যুদ্ধে স্বাধীনতাপন'ী মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড বিবেচনায় না নিয়ে তাদের দায়মুক্তি অব্যাহত রাখা হয়। সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ির বিচারে প্রণীত ১৯৭৩ সালের মূল খসড়ায় বিদ্যমান ফাঁকফোকর এখন ৪০ বছর পর কতিপয় বেসামরিক ব্যক্তিকে শাস্তিদানের একটি উপায় হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে।’
ব্যারিস্টার জন কমেহ আরো লিখেছেন, 'For the Act to be resurrected almost 40 years later in virtually unchanged form suggests, at best, that the government has little interest in conforming with modern standards- despite being a state party to the International Criminal Court and a signatory to the International Covenant on Civil and Political Rights. At worst, two years ahead of the next general election, it portrays a cynical determination to eliminate opposition figures for political gain.’ অর্থাৎ ‘প্রায় ৪০ বছর পর পুনরুজ্জীবিত এ অ্যাক্ট দৃশ্যত অপরিবর্তিত রাখায় মনে হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি পক্ষ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষরদানকারী হওয়া সত্ত্বেও সরকার আধুনিক মানদণ্ড মেনে চলার ব্যাপারে উদাসীন। আরো ভয়াবহ হলো যে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের দু’বছর আগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সরকার বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে নির্মূলে কঠোর দৃঢ়সংকল্প।’
ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস স্কুল অব ল-এর অধ্যাপক ক্রিস্টিন এ হাস্কিও বালাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল ইন বাংলাদেশ: উইল জাস্টিস প্রিভেইল?’ শিরোনামে অনুরূপ একটি ভাষ্যে লিখেছেন, 'While an estimated 1,600 people took part in the atrocities, it is clear that the Tribunal will not be prosecuting soldiers in the Pakistani army or the Bengali freedom fighters. Instead, the government appears to be targeting only Bangladeshi citizens accused of collaborating with West Pakistan and committing certain crimes. অর্থাৎ ‘নৃশংসতায় আনুমানিক ১ হাজার ৬ শ’ লোক অংশগ্রহণ করলেও স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে, এ ট্রাইব্যুনাল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্য অথবা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার করবে না; বরং মনে হচ্ছে সরকার কেবল পশ্চিম পাকিস্তানিদের সহায়তা দান এবং কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের টার্গেট করছে।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা কেউ করছে না। বিচারের আগে যুদ্ধাপরাধীদের শনাক্ত করতে হবে। আজকে যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলা হচ্ছে তারা তো এত দিন এ দেশেই ছিলেন। কেউ তো কখনো তাদের যুদ্ধাপরাধী বলেনি। হ্যাঁ, বলেছে স্বাধীনতাবিরোধী। রাজাকার বলে গালিও দিয়েছে। সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, ঘাতক দালালও বলা হয়েছে। হঠাৎ করে কথিত স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার কিংবা ঘাতক দালালেরা যুদ্ধাপরাধী হয়ে উঠল কিভাবে জাতির কাছে আগে তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে হবে। সত্যি সত্যি তারা যদি যুদ্ধাপরাধী হয়ে থাকেন তাহলে বিগত দিনের বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা এবং বক্তৃতা ও ভাষণে তাদের যুদ্ধাপরাধী বলা হলো না কেন। একেই বলে রাতকে দিন করা আর দিনকে রাত করা। আমরা যত সহজে উচ্চারণ করি, যুদ্ধাপরাধ করা তত সহজ নয়। এ ধরনের অপরাধীরা কত উঁচু পদমর্যাদা এবং ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালে দণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকার প্রতি তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন